ইসরায়েলি বর্বর বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের মানুষের সাথে সংহতি জানিয়ে রাজধানীতে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন লাখো জনতা। গতকাল ,শনিবার (১২ এপ্রিল ২০২৫) ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এ কর্মসূচির কারণে শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, নীলক্ষেত, টিএসসি, পলাশীসহ আশপাশের এলাকার সড়কে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
সমাবেশে দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের লোকজন এবং ওলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে তৈরি মার্চ ফর গাজা ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার, গণহত্যা বন্ধে কার্যক্রর পদক্ষেপ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কট এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এর পূর্বে ফেসবুকে ‘মার্চ ফর গাজা’ নামে একটি ইভেন্ট পেজ তৈরি করে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন সংগঠন, ইসলামী বক্তা ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কর্মসূচিতে যোগ দেন।
কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেতে শুরু করেন। এতে শাহবাগ ও আশপাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাংলামটর, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা এলাকা হয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে আসতে থাকে। পিকআপ ভ্যানে করে নারী শিশুরাও স্লোগান দিতে দিতে কর্মসূচিতে যোগ দেন।
বেলা সোয়া ৩টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়ে ৪টার দিকে ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। অনুষ্ঠানে ‘আমার ভাই শহীদ কেন, জাতিসংঘ জবাব চাই’, ‘গাজায় গণহত্যা কেন, জাতিসংঘ জবাব চাই’, ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন, ফ্রি ফ্রি আল আকসা’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর– জেনোসাইড নো মোর’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়।
ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দ্বিতীয় অংশে মুসলিম বিশ্বের সরকার ও উম্মাহের প্রতি এবং তৃতীয় অংশে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আলাদা দাবি জানানো হয়।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি উদ্দেশ করে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদারকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। এই বিশ্ব ব্যবস্থা দখলদার ইসরায়েলকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বলছি, জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে; যুদ্ধবিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে; ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে; ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয় দাবিগুলো মুসলিম উম্মাহর নেতাদের প্রতি জানানো হয়। এতে বলা হয়, যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অংশ; গাজা এখন শুধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি; ভারতের হিন্দুত্ববাদ আজ এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত দমন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে; ভারতে সম্প্রতি ওয়াক্ফ সম্পত্তি আইনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা উম্মাহর জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
এতে তারা মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসিসহ মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর কাছে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানান। এতে বলা হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে; জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে; গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে এক ঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে।
তৃতীয় অংশে আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ছয়টি দাবি জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শর্ত পুনর্বহাল করতে হবে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে; সরকারের ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে; রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে; পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।